সোমবার   ০২ অক্টোবর ২০২৩   আশ্বিন ১৬ ১৪৩০   ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

  যশোরের আলো
সর্বশেষ:
যশোরে আমনের সবুজ ধানক্ষেতে স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরা চৌগাছায় পেঁয়াজ বীজ পেলেন ১৭০ কৃষক রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার ফ্রিল্যান্সারদের ১০ শতাংশ উৎসে কর প্রযোজ্য নয়: এনবিআর ১৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে জাপান চুক্তি স্বাক্ষর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই
৭৩৮

সত্যিকার অর্থে আমাদের সিনেমা এখনও ইন্ডাস্ট্রি হতে পারেনি : কবরী

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০১৯  

বাংলা সিনেমায় যে কয়জন অভিনেত্রী খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করছেন তাদের মধ্যে অভিনেত্রী কবরী অন্যতম। নিজের অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে দর্শক হৃদয়ে আজও জায়গা নিয়ে আছেন তিনি। অভিনয় করে যেমন খ্যাতি যশ অর্জন করেছেন তেমন অভিনয় করতে গিয়ে অনেক কষ্টও করেছেন।

এ অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ে নেই। বর্তমান ব্যস্ততা, সিনেমা নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি যুগান্তরের মুখোমুখি হয়েছেন এ অভিনেত্রী।

যতদূর জানি মিনা পাল নামের সুন্দরী মেয়েটি ‘সুতরাং’ সিনেমাতে অভিনয় শুরু করেন কবরী নামে। এ ছবিতে আসার সারাংশটা যদি বলতেন?

কবরী: ষাটের দশকের কথা। সুভাষ দত্তের স্বপ্ন ছিল একটি সিনেমা বানাবেন। যার জন্য একজন প্রযোজক তাকে ষাট হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রয়াত কবি সৈয়দ শামসুল হক তাকে সাহস দিয়েছিলেন। পরে সৈয়দ শামসুল হক, সত্য সাহা ও সুভাষ দত্ত- এ তিনজন মিলে ‘সুতরাং’ নামে একটি ছবি বানানোর জন্য প্রাথমিক কাজ শুরু করেন।

এর মধ্যে চিত্রনাট্য ও গানগুলো তৈরি হয়ে গেল। একজন নায়িকা দরকার যাকে সুভাষ দত্তের সঙ্গে মানাবে। পরে জেনেছি সুভাষ দত্ত নায়ক চরিত্র করছেন শুনে অনেকেই হাসাহাসি করতেন। তারা ধরেই নিয়েছিলেন ছবিটি ফ্লপ করবে।

ওই সময় সত্য সাহা আমার কথা বললেন সুভাষ দত্তের কাছে। পরে আমার বাবার সঙ্গে এ তিনজনের কাছে গেলাম। বেশকিছু ঘটনার মধ্য দিয়েই সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে আমাকে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত করলেন। তখন আমার নাম ছিল মিনা পাল। সুভাষ দত্ত আমার নাম দিলেন কবরী।

এ নাম দিয়েই অভিনয় জগতে আত্মপ্রকাশ করি। মানুষ আমাকে কবরী নামে চেনেন। মানুষের ভালোবাসা নিয়ে আজও পথ চলি।

ওই সময়গুলোয় আপনার অভিনয় চর্চার জায়গা কেমন ছিল?

কবরী: আসলে এ শতাব্দীতে এসে তারকা, সুপারস্টার, আইডল ও আইকনসহ বিভিন্ন রকম খ্যাতির নাম শুনছি এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমাদের সময় এসব ছিল না। আর ‘তারকাখ্যাতি’ শব্দটির সঙ্গে আমি কখনও পরিচিত ছিলাম না। শুটিং সেটে আসার আগ পর্যন্ত চর্চার মধ্যে থাকতাম।

মনে মনে ভাবতাম, শট যদি ঠিক মতো না দিতে পারি তবে মনে হয় আমি বাদ পড়ে যাব। তা ছাড়া অভিনয় তো চর্চার বিষয়। চর্চা না করলে আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব কীভাবে? সুন্দর, স্মার্ট দিয়ে কী সব হয়? শুরু থেকে যদি চর্চা না চালিয়ে আসতাম তবে আজ এ অবস্থানে আসতে পারতাম না। অভিনয়কে উপাসনার মতো ভেবেছি। যত্নসহকারে কাজ করেছি। তাই আজও মানুষ আমাকে মনে রেখেছেন এবং আমাকে ভালোবাসেন।

এখন তো অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে প্রায় কাদা ছোড়াছুড়ির খবর শোনা যায়। আপনাদের সমসাময়িক নায়ক-নায়িকাদের প্রতিযোগিতা কেমন ছিল?

কবরী: আমাদের শুরুর সময়ও একের প্রতি অন্যের হিংসা ছিল। তবে প্রকাশ হতো না। আমরা যে হিংসা করেছি সে জন্যই টিকে আছি। আমরা হিংসা করেছি ওই নায়িকার চেয়ে ভালো অভিনয় করতে হবে। ওই নায়িকার ছবিটা হিট হয়েছে, আমাকে তার চেয়ে ভালো একটি হিট ছবি উপহার দিতে হবে। মোট কথা, কাজ নিয়ে হিংসা করতাম। কার কাজ ভালো, তার থেকে আমি আরও ভালো করব। কিন্তু এখনকার শিল্পীদের মতো খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়িনি। কে বড় তারকা, কে ছোট তারকা এসব ভেবে সময় নষ্ট করিনি।

যুগান্তর: আপনার অভিনীত ‘সুতরাং’ সিনেমাটি ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম বাংলা সিনেমা। সে সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?

কবরী: আসলে সে সময় কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। আমার অভিনীত সিনেমা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে এ নিয়ে আমার কোনো বিশেষ অনুভূতি কাজ করেনি। ভালো কাজ করেছি বলে হয়তো মানুষ পছন্দ করেছেন। এখনও ভালো কাজ হলে মানুষ তার আলোচনা করেন। আর ভালো কিছু দেখতে চান।

আপনার সঙ্গে অনেক খ্যাতিমান চিত্রনায়ক অভিনয় করেছেন। তাদের সঙ্গে আপনার অভিনয়ের রসায়নটা কেমন ছিল?

কবরী: অবশ্যই ভালো ছিল। একটি ছবিতে শুধু নায়ক-নায়িকার রসায়ন নয়, প্রতিটি চরিত্রে কাজ করতে গিয়ে যদি ভালোবাসার জায়গাটা না থাকে তবে কাজ ভালো হবে না। আমরা যারা কাজ করেছি তারা একে অন্যের বিষয় নিয়ে ভাবিনি। আমরা ভেবেছি পরিচালক, প্রযোজকের কথা। আমরা ভালোভাবে কাজ করলে মানুষ সিনেমা দেখবেন, পরিচালক-প্রযোজক নতুন সিনেমা বানাতে আগ্রহী হবেন। ওই চিন্তা করেই কাজ করতাম। কতটা ভালো কাজ করতে পেরেছি তা দর্শক বলতে পারবেন।

বাংলাদেশে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম সিনেমার নায়িকা আপনি ছিলেন। সোহেল রানা ছিলেন আপনার সহশিল্পী...

কবরী: আমি অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়কে বড় আবার কোনো বিষয়কে ছোট করে দেখিনি। সব কাজকেই আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। মাসুদ রানা সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই করেছি। তবে এ সিরিজটি পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল বলা চলে। সে অনুযায়ী পাঠকরাও সিনেমা আকারে তাদের পছন্দের চরিত্রে দেখতে চেয়েছিলেন। আর আমারও অভিনয় করতে ভালো লেগেছে। সোহেল রানাও একজন ভালো অভিনয় শিল্পী। আমরা ভালো মতো কাজটি করেছি বলেই দর্শক এখনও সে সিনেমার কথা বলেন।

আপনাদের সময়কার সিনেমায় অধিক চরিত্র থাকত। প্রত্যেকটি চরিত্রই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখন সিনেমাতে চরিত্রের সংখ্যাও কমে গেছে। এতে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

কবরী: শিল্পী বেকারত্বের এটা অন্যতম একটি কারণ। এখন দর্শক সিনেমার মাধ্যমে কী পাচ্ছে এ বিষয়টিও বুঝতে পারি না। আমাদের সময় একটি সিনেমায় অনেক শিল্পী কাজ করতেন। নির্মাতা শুধু নায়ক-নায়িকার ওপর নির্ভর থাকতেন না। গল্পকে পুঁজি করে তারা সিনেমা বানাতেন এবং ত্রিশ সেকেন্ড কিংবা এক মিনিটের একটি চরিত্রকেও গুরুত্ব দিতেন। এখন তো সেই বিষয়গুলো নেই। সিনেমা যাও হচ্ছে তাতে হাতেগোনা চরিত্র দিয়ে শেষ হয়ে যায়।

আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা কেমন আপনার দৃষ্টিতে?

কবরী: আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা সম্পর্কে আর কী বলব? আমাদের দেশে তো অনেকেই সিনেমা জগতকে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বলে থাকেন। সত্যিকার অর্থে আমাদের সিনেমা এখনও ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হতে পারেনি। আগামীতে ইন্ডাস্ট্রি হতে পারবে কিনা সেটাও আমি নিশ্চিত নই। কারণ, এখন সিনেমা হচ্ছে না। যে ক’টি নির্মিত হচ্ছে সেগুলোও খুব বেশি মানসম্মত নয়। যে কারণে সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সিনিয়র যারা আছেন তারাও এখন সিনমাতে নেই। সিনেমায় কেউ অর্থ লগ্নি করছেন না। মনে হচ্ছে একটা অস্থির অবস্থা। এখানে এখন কোনো ভালোবাসা নেই আগের মতো।

আপনিও তো দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ে নেই। কারণ কী?

কবরী: কোনো কারণ নেই। অভিনয়ের প্রস্তাব এলেও পছন্দ অপছন্দ বিবেচনা করি। এ সময়ে অনেকেই যে চরিত্র নিয়ে আসেন সে চরিত্রে কাজ করতে আমি প্রস্তুত নই। মা-বা অন্য কোনো বয়স্ক চরিত্রে এখন আমার হয়তো অভিনয় করতে হবে কিন্তু মায়ের চরিত্রটিই যদি সুন্দর না হয় তবে কেন অভিনয় করব। তবে একটি সিনেমায় কিছুদিন আগে কাজ করেছি। ‘মন দেব মন নেব’ নামে সিনেমার বিশেষ একটি চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন রবিন খান। আশা করছি এটি দর্শকদের ভালো লাগবে।

এক যুগ আগে ‘আয়না’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন। এরপর নতুন একটি সিনেমা পরিচালনা করার কথা ছিল। কবে নাগাদ কাজ শুরু করবেন?

কবরী: এ সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য তৈরি করা আছে। সিনেমার নামও ঠিক করেছি। ‘সেই তুমি এই তুমি’। এতে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনা দেখানোর চেষ্টা করব। সরকারি অনুদানের জন্য কয়েকবার আবেদন করেছি। কিন্তু কেন আমাকে অনুদান দেয়া হয়নি তাও জানি না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নতুন যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন তার কাছেও আবেদন করেছি কিছুদিন আগে। দেখা যাক কী হয়। অনুদান পেলে কাজ শুরু করব। এ ছবিতে আমিও অভিনয় করতে পারি। তবে সবকিছু সময়ের ওপর নির্ভর করছে।

জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নিয়ে আজও কী ভাবেন, কাঁদেন কিংবা হাসেন?

কবরী: অনেক ঘটনাই তো আছে। তবে একটি ঘটনা আমি এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলাম। ওই সময়ও নায়িকা হিসেবে আমার পরিচিতি ছিল অনেক। নায়িকা হয়েও আমি দেশ ছেড়ে পালাই। পুরনো ছেঁড়া একটি শাড়ি পরা। গায়ে ধুলো-বালি লেপটে ছিল। ভাবতে পারিনি আমি নায়িকা কবরী, জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। এ স্মৃতি মনে পড়লে বুক ফেটে কান্না আসে। আবার হাসিও, থাক না এসব, মানুষের জীবনে তো এমন ঘটনা ঘটবেই।

এখন অবসর সময়গুলো কীভাবে কাটে আপনার?

কবরী: ব্যক্তিগত কাজ আছে। সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। ইদানীং বই পড়ার প্রতি মন টানছে খুব। কিছু বই পড়ছি। পাশাপাশি লেখালেখিও করি। এভাবেই দিন কেটে যায়।

  যশোরের আলো
  যশোরের আলো
এই বিভাগের আরো খবর