বুধবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আশ্বিন ১১ ১৪৩০   ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

  যশোরের আলো
২০৯৩

ঝিকরগাছার আদ্যোপান্ত

ইয়াকুব আলী

প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০১৮  

১৯৭৭ সালে ঝিনাইদাহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ৩টি, মহেশপুর উপজেলার ৩টি ও যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ২টি ইউনিয়নকে ৫টি ইউনিয়নে বিভক্ত করে মোট ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলাটি গঠিত হয়। এ উপজেলার পূর্বে যশোর সদর, দক্ষিণে ঝিকরগাছা, দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পশ্চিমে মহেশপুর, উত্তরে কোঁটচাদপুর এবং উত্তর-পূর্বে কালীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। বর্তমান জন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ।


উপজেলার আয়তন : ২৬৯.৩১ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিন্তান সীমান্ত জুড়ে মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া ও বর্ণী নামে ৪টি সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চল ৮ নং সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) খন্দকার নাজমুল হুদা।


স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর থেকে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে যুব সমাজ সংগঠিত হতে থাকে। উপজেলার জগদীশপুর গ্রামে মার্চ মাসের প্রথম থেকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মহড়া চলছিল।২৯ মার্চ ফুলসারা-পাশাপোল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্্জাহান কবিরের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা মহড়ায় থাকা ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) হাফিজকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রত্যাবর্তন না করে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গার ই.পি.আর (বর্তমান বি.জি.বি) হেড কোয়ার্টার থেকে সুবেদার আবু ওসমানের নেতৃত্বে এক দল ই.পি.আর সদস্য সলুয়া বাজারে অবস্থান নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট লক্ষ্য করে পাক সেনাদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে । 

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি : তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য তবিবর রহমান সরদার ও হাফিজুল্লাহ কানন,ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বনগাঁয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিসে ও মহেশপুর থানার আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মল্লিক এবং একই কমিটির দপ্তর সম্পাদক দেবাশীষ দাস ভারতের বাগদাহ ও চৌগাছা-সিংহঝুলি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ভারতের কুরুলিয়ায় অবস্থান নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় এ অঞ্চল থেকে যাওয়া যুবকদের সংগঠিত করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতেন। এসময় চৌগাছার গরীবপুর গ্রামের ডা: মহর আলীর ছেলে মিজানুর রহমান মধু ভারতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দর সাথে একাধিবার বৈঠকে মিলিত হন। তিনি ভারতে অবস্থান নিয়ে মুক্তি যুদ্ধাযোদ্ধাদের রসদ যোগান দিতেন। বনগাঁয় ১নং টালীখোলা থেকে ৫নং টালীখোলা ও চাঁপাবাড়িয়া নামক স্থানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুনের টান্ডুয়া, আসামের হাফলং এবং বিহারের চাকুলিয়া প্রভৃতি ক্যাম্পে পাঠানো হতো। 

মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ : ৩১ মার্চ ই. পি. আর বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যগণ ভারতের বি. এস. এফ, নকশাল ও স্বাধীনতাকামী জনতার সহযোগিতায় ই.পি.আর বাহিনীর পাকিস্তানি সদস্যদের হত্যা করে চৌগাছা সীমান্তের মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া ও বর্ণী ই.পি.আর ক্যাম্প দখল করে নেয়। এটাই ছিল এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ । 

পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন : ২০ এপ্রিল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর একটি দল তৎকালীন ছোট সিংহঝুলি (বর্তমান মশিউর নগর) ও সিংহঝুলি গ্রামের ১৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা, ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চৌগাছায় প্রবেশ করে। চৌগাছায় ও একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যাসহ অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। পরবর্তীতে ২৬ এপ্রিল পুনরায় চৌগাছায় প্রবেশ করে চৌগাছা শাহাদৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও জেলা পরিষদের ডাক বাংলায় প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে৪। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর আব্বাস উদ্দিন। এছাড়া এ ক্যাম্পের অধীনে মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া, বর্ণী  ই. পি. আর ক্যাম্প, দশপাকিয়ার দত্তের পুকুরপাড়, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলার মাঠ, হাকিমপুরের আমবাগান, আড়পাড়ার ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যাম্প ও ট্যাংঙ্ক বিধ্বংসী ঘাঁটি স্থাপন করে ।

পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠনের ঘটনাঃ ক্যাম্প স্থাপনের পর জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পিছনে পাকসেনারা স্থানীয় অসংখ্য মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে জোরপূর্বক ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা  করে। ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এই বাংলোর পিছনে হত্যা করা হয়ে বলে বাংলোর তৎকালীন দারোয়ান বলেন মোঃ আব্দুল বারিক জানান । ইছাপুর গ্রামের বি. ডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বার মোঃ আক্কাচ আলী বিশ্বাসের উপর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকসেনারা উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তিনি বিষপানে  আত্মহত্যা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত কবর দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। মাঝে মাঝে পাশ্ববর্তী কংশারীপুর ও পাঁচনামনা গ্রাম থেকে গভীর রাতে নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ শোনা যেত। ৩১ মে চৌগাছার অপর ৩জন ব্যক্তির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও তাঁর ডিসপেনসারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী রাখার অভিযোগে ডাঃ বজলুর রহমানকে বন্দি করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ১৩ জুন ডাঃ বজলুর রহমান ছাড়া আটককৃত অন্য ৩ জনকে পাকসেনারা মুক্তি দেয়। চৌগাছার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করায় ডাঃ বজলুর রহমানই প্রথম শহীদ হন। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাথে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের জন্য চৌগাছার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের উপরে কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়। এ ব্রীজ নির্মাণের সময় স্থানীয় গ্রামবাসীদেরকে মধ্য যুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে মাটি কাঁটিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে বাধ্য করা হতো। এছাড়াও অন্যান্য ক্যাম্প গুলিতেও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। 

পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রঃ পাক বাহিনী চৌগাছা ডাকবাংলা,চৌগাছা শাহাদৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাশিলা, হিজলী ও বর্ণী ই. পি. আর ক্যাম্প, দশপাকিয়ার দত্তের পুকুরপাড়, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলার মাঠ, হাকিমপুরের আমবাগান, আড়পাড়ার ভূমি অফিসে নির্যাতন কেন্দ্র ও বন্দি শিবির স্থাপন করে।

বধ্যভূমি ও গণকবরঃ চৌগাছায় পাকসেনাদের হত্যা যজ্ঞের সাক্ষী হিসেবে বহু বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে।  সেগুলো হলো চৌগাছা (জেলা পরিষদের) ডাকবাংলার উত্তর পাশে মৌজা নং ১৭১, দাগ নং ৩, বর্তমান উপজেলা পরিষদের সম্মুখে মৌজা নং ১৭১, দাগ নং ১১৮, আড়পাড়া বাজার সংলগ্ন মৌজা নং ২১৬, দাগ নং ১৮৭, মাশিলা ফকির শাহের আঁকড়া, মৌজা নং ৪০, দাগ নং ৮৩২, সাঞ্চাডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে, মৌজা নং ১৬২, দাগ নং ৯ ও ১০, বর্নী  ই. পি. আর ক্যাম্পের উত্তর পার্শ্বে মৌজা নং ১২২, দাগ নং ৭২০ ও ৭২২, বর্ণী ই.পি.আর ক্যাম্পের পশ্চিম পার্শ্বে মৌজা নং ১২২, দাগ নং ১০০৩, মাঠ হাকিমপুর ফকির চানের আমবাগান, মৌজা নং ৫৪, দাগ নং ৯৯৭ ও ১০১০,  পুড়াপাড়া ব্রীজের পার্শ্বে টেরীতলা নামক স্থানে মৌজা নং ১৮, দাগ নং ২৫৩৪ ও ১৫৩৫, হাজরাখানা পালপাড়ায় অবস্থিত মৌজা নং ১৯১, দাগ নং ১৯১। 


মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকঃ এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তৎকালীন যশোর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি উজিরপুর গ্রামের হাজী নুর বক্স,ফুলসারা-পাশাপোল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ফুলসারা গ্রামের মহাসীন আলী মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শাহ্্জাহান কবির,সিংহঝুলী গ্রামের আলী কদর  শামছুজ্জামান মিয়া, চানপুর গ্রামের হাজি মর্ত্তজ আলীর ছেলে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান এস. এম. হাবিবুর রহমান, জগদীশপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন আশা,পাতিবিলা ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ নেতা সামসুল আলম,যাত্রাপুর-হাকিমপুর ইউনিয়নের আওয়ামলীগ নেতা নিতাই চন্দ্র সরকার ও দাউদ হোসেন খান, শার্শা থানার শিববাস গ্রামের প্রফেসর আমিরুল আলম খান। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আড়ারদাহ গ্রামের আব্দুস সাত্তার,গরীবপুর-পিতম্বরপুর গ্রামের ডা: মহর আলীর ছেলে মিজানুর রহমান মধু।

পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধঃ  বিমান, ট্যাংঙ্ক ও হাতাহাতি যুদ্ধের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোরের চৌগাছার মুক্তিযুদ্ধোকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। ভয়াবহতম এ যুদ্ধ সংগঠিত হয় চৌগাছার জগন্নাথপুরের (বর্তমানে মুক্তিনগর) আমবাগানে। সামরিক ইতিহাসে এ যুদ্ধকে গরীবপুরের যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মূলতঃ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের যুদ্ধ,এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। কারণ যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য আর কোন যুদ্ধ হয়নি। এ আমবাগানের দক্ষিণে গরীবপুর ও বাড়ীয়ালী, পশ্চিমে গরীবপুর ও জামলতা, উত্তর-পশ্চিমে সিংহঝুলি, উত্তরে ছোট-সিংহঝুলি (বর্তমান মশিউর নগর) পূর্বে ফুলসারা গ্রামের মাঠ। সীমান্তে যুদ্ধোগুলোতে একে একে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১২ নভেম্বর থেকে পাকসেনারা ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে নিতে শুরু করে। প্রথমে চৌগাছা ও পরে জগন্নাথপুর এবং সিংহঝুলিতে অবস্থান দৃঢ় করে। উভয় পক্ষের প্রচন্ড গুলাগুলি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ২১ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর উভচর ট্যাঙ্কগুলি বয়রা সীমান্তের কপোতাক্ষনদ পার হয়ে চৌগাছায় প্রবেশ করে। সন্ধার পর থেকেই ট্যাঙ্কগুলি অবিরাম গুলিবর্ষন শুরু করে। ২২ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর নেতৃত্বে নবম ইনফেন্ট্রি ডিভিশন গরীবপুর ও তার আশেপাশের গ্রামে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতেৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাদের সাথে যোগ দেয়।  শুরুু হয় প্রচন্ড সংঘর্স। 

উভয়পক্ষের তীব্র গোলাগুলির মধ্যে বিকালে পাকিস্থানি বিমান বাহিনীর ৪টি স্যাবরজেড জঙ্গি বিমান মুক্তি বাহিনীর অবস্থানে আসা মাত্রই ভারত থেকে মিত্র বাহিনীর ৫টি ন্যাট আর জেট জঙ্গি বিমান উড়ে এসে পাকিস্থানী বিমানগুলোকে ঘিরে ফেলে, ২ টিকে গুলি করে ভূপাতিত করে এবং ১টিকে বন্দি করে ভারতের অভ্যন্তরে অবতরণে বাধ্য করে। অপর বিমানটি নিরাপদে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে ২ জন পাইলটও বন্দি হয়। ভারতীয় বাহিনী পাকবাহিনীর ১৩ টি শাফে ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে । মিত্র বাহিনীরও ৬ টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। শেষ পর্যায়ে এ যুদ্ধ আশপাশের গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনগণ মুক্তিবাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিকামী গ্রামবাসীরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩টি শাফে ট্যাঙ্ক আটক ও ৭৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। বাকী সৈন্যরা মার্কিন ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও ট্যাঙ্ক ফেলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। 

দেশে বিদেশের নানামুখী তৎপরতায় এ লড়াইয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ২২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্থানের সামরিক কমান্ডার নিয়াজী সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে  যশোর ক্যান্টনমেন্ট সফর করেন। এ যুদ্ধে ভারতের ৩০০ সৈন্য নিহত, ৫০০ সৈন্য আহত, ৮ টি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত হয় বলে ২৩ নভেম্বর দৈনিক পাকিস্থান পত্রিকা ফলাও করে প্রচার করে। আন্তর্জার্তিক সমর্থন বাড়ানোর জন্য পাকিস্থানি সামরিক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর বিধ্বস্ত ট্যাঙ্ক দেখাতে বিদেশী সাংবাদিকদের গরীবপুরে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেছিল,কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতার কারনে তা ভেস্তে যায়। এ প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী সভা আহবানের দাবী জানান। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্ট উভয়পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহবান জানান। তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ২১ ও ২২ নভেম্বরের এ যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু বলে উল্লেখ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রারাগান্ধি ২৪ নভেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে এ যুদ্ধের বর্ননা দেন । তখনও পাক - ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষিত হয়নি। ফলে কূটনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় এ যুদ্ধকে সীমান্ত সংঘর্ষ বলে চালানো হচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ২৩ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বিজয় অত্যাসন্ন বলে জাতিকে উজ্জীবিত করে ভাষণ দেন। পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক উৎসাহ ও মনোবল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। 

এ যুদ্ধ ছাড়াও বুড়িন্দিয়া দত্তপুকুরের পাড়,মাশিলার ফকির শাহ্রে আঁখড়া, বর্ণী ই.পি.আর ক্যাম্প, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলা, হাকিমপুরের আমবাগানেও ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। বহু মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও পাকসেনা হতাহত হয়। ঝিকরগাছা থানার মুজিব বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল আলিমের নেতৃত্বে আব্দুস সাত্তার, আমিরুল আলম খান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ মুজিববাহিনীর সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন।  অত:পর চৌগাছা তথা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
পাকবাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন যারা : ৮জন শহীদের নাম ঠিকানা ও কবর স্থানের সন্ধান মিলেছে। তারা হলেন  যাত্রাপুর গ্রামের হোসেন মিয়ার ছেলে জয়নাল আবেদীন। চন্দ্রপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে মোজাহার আলী,   কোটালীপাড়া গ্রামের মহর আলীর ছেলে খাইরুল ইসলাম। আফরা গ্রামের শফিউল্লাহর ছেলে নুরুল ইসলাম, জগন্নাথপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে সুজাউদ্দৌলা । রামকৃষ্ণপুর গ্রামের জাহাব আলীর ছেলে গোলাম কবির। উজিরপুর গ্রামের কটাই মন্ডলের  সিরাজুল ইসলাম ও শফিউল্লাহ মৃধার ছেলে  মনির হোসেন ।  

স্বধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি: ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন এম এন এ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) শহীদ মসিয়ূর রহমানের গ্রাম মনে করে ছোট সিংহঝুলী গ্রাম পাকবাহিনী  প্রথম জ্বালিয়ে দেয়। সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে মসিয়ূরনগর। গ্রামের প্রবেশ পথে ১টি বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। সিংহঝুলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি শহীদ মসিয়ূর রহমানের নামে নামকরণও করা হয়। জগন্নাথপুর গ্রাম মুক্ত হলে ওই গ্রামের নামকরণ মুক্তিনগর এবং মুক্তিনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করা হয়। বুড়িন্দিয়ার দত্তপুকুরের পাড়ে ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চৌগাছা শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্বাধীনতার স্মৃতি স্মারক ভাস্কর্য ‘দুর্জয় দুর্গ’ নির্মাণ করা হয়। এ ভাস্কর্যটির নির্মাণ শিল্পী মোঃ আতিয়ার রহমান। ১৯৬১ সালে স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তারপুর গ্রামে এলে তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য উক্ত গ্রামে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়।

হানাদার মুক্ত দিবস: সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর শুরু হলো আড়পাড়া মাঠের যুদ্ধ। এ মাঠের পশ্চিমে দূর্গাপুর, উত্তরে  তেঁতুল বেড়ে, পূর্বে কাস্টভাঙ্গা, দক্ষিণে চারাবাড়ির মাঠ। এ মাঠের উত্তর-পশ্চিমে জগদীশপুর থেকে মিত্র বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর জগৎ সিং অড়োরার নেতৃত্বে যৌথবাহিনী অগ্রসর হলে পাকবাহিনী তাদের ঘাঁটি থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর সুবেদার আয়ুব খান অগ্রসর হয়ে পাকসেনা ঘাঁটির পিছন দিক থেকে ট্যাঙ্ক আক্রমণ চালালে এ ঘাঁটির পতন হয়। যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা মারা যায় ও ৩৬ জন মিত্রসেনা শহীদ হন। এ যুদ্ধে মোঃ মোবাশ্বের আলী, মোঃ সোহরাব হোসেন, মোঃ শহিদুল ইসলাম ও নড়াইল জেলার রেজাউল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশ গ্রহণ করেন। অতঃপর ৩ ডিসেম্বর চৌগাছায় মুক্ত হয়। দেশের প্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চৌগাছাকে স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার বলা হয়। 


 

  যশোরের আলো
  যশোরের আলো