বুধবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আশ্বিন ১১ ১৪৩০   ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

  যশোরের আলো
৮৫৬

বলিষ্ঠ কূটনীতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরানো যাবে না

নিউজ ডেস্ক:

প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০১৯  

রোহিঙ্গাদের নিয়ে যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল ঘটনাক্রম ধীরেসুস্থে হলেও সেদিকেই এগিয়ে চলেছে; এবং তা একাধিক মাত্রায়। রোহিঙ্গাদের  সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রথম ও শেষ কথা তাদের নিজ দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্বিঘ্ন, নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বসবাস নিশ্চিত করতে হবে।

বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক এখতিয়ারের। অর্থাৎ তারা যেন নিজ দেশে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা দ্বারা গণহত্যার শিকার না হয়। কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রেই সমস্যা অনতিক্রম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক শক্তির অসহযোগিতার কারণে। তারা নিজ নিজ রাষ্ট্রিক স্বার্থের টানে বাংলাদেশের এ চরম আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে।

বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া। চীনের স্বার্থ প্রত্যক্ষ। মিয়ানমারের সঙ্গে তার বহুবিধ পথে সংশ্লিষ্টতা। সীমান্ত সংলগ্নতা থেকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ থেকে রাজনৈতিক স্বার্থে চীন মিয়ানমারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই মিয়ানমার সরকারের গণহত্যা তাদের চোখে পড়ে না, মানবিক বিচার বিবেচনা তাদের হিসাবে আসে না। ফলে মিয়ানমারের প্রতি তাদের অন্ধ সমর্থন।

কিন্তু রাশিয়া? তাদের স্বার্থটা তো মূলত রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক। তবু তারা মানবিক বিবেচনাকে শিকেয় তুলে রেখেছে। বাংলাদেশের সমস্যা তাদের আলোড়িত করছে না। যেমন করেছিল ১৯৭১ সালে। তাই বলে এমন যে প্রতিবেশী দেশ, মিত্র দেশ ভারত, সেও এ ব্যাপারে উদাসীন হবে কেন? কিন্তু হচ্ছে।

আর যুক্তরাষ্ট্র? বাংলাদেশকে নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইস্যুতে ব্যবহার করছে, কিন্তু তার সংকটে, সমস্যায় মুশকিল আসানে নিষ্ক্রিয় বরং বানরের ভিন্ন মাত্রিক পিঠা ভাগে নতুন উদ্যোগের কথা ভাবছে। সর্বোপরি এ সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার সমাজ বৃহত্তর সমস্যায় জড়িয়ে পড়বে। এ দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক সত্যটা বাংলাদেশ যেমন বোঝে, তেমনি বোঝে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো।

দুই.

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার বর্বরতায় যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশ সীমান্তের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয়ের আর্তিতে আছড়ে পড়েছিল, তখনই আমরা এর নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আগাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলাম। এ সতর্কতাকে ভুল বুঝেছিলেন আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা। এখন তাঁরা  রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কী বলবেন জানতে ইচ্ছা করে। এমনকি এজাতীয় সংকটে তাঁরা  নীরব কেন, তাও জানতে ইচ্ছা করে।

রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশে নানা ধারায় যে বিচিত্র  সমস্যার সৃষ্টি করছে তা-ই নয়, তাদের কর্মকাণ্ড যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে অধিকতর রাজনৈতিক জটিলতায় ও সমস্যায় নিক্ষেপ করবে সে আলামতও এখন খুব স্পষ্ট। সমস্যা রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও বহুবিধ।

রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়ে পরে বলি। প্রথমেই  সামাজিক দিকগুলোর প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ক্রমেই অনৈতিকতার ঘাঁটি হতে শুরু করেছে। নারীপাচার, শিশুপাচারের অন্ধকার তৎপরতার সম্রাটদের জন্য লোভনীয় শিকার হতে শুরু করেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প।

স্থানীয় দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। মাদক ব্যবসা থেকে নারীদেহ ব্যবসার মতো ঘটনা সংবাদপত্রের খবর হলেও তার বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। অর্থবিত্তের স্বার্থপর হাঙর-কুমিরের লালসাপূর্ণ চোখ এখন রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে। স্থানীয় সমাজে এর কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য।

মাঝেমধ্যে এসব ঘটনা দৈনিকগুলোর খবর। এ মুহূর্তে সংবাদপত্রে একটি শিরোনাম : ‘রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসায়’। ভয়ংকর সংবাদ। আর পড়বেই বা না কেন? শরণার্থী  শিবিরের জীবন তো স্বচ্ছন্দ জীবন নয়। জানে একাত্তরের বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। জানে বাংলাদেশে জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিকুল। জানে বিশ্বজুড়ে শরণার্থী মাত্রেই। তাই স্বচ্ছন্দ, সচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায় তাদের তারুণের অন্ধকার জগতের দিকে হাত বাড়ানো।

আর এটা সম্ভব হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনায় বাংলাদেশি প্রশাসনের উদাসীনতায় এবং সেই সঙ্গে উচ্চ নৈতিক মানের অভাবে। শিবিরের শৃঙ্খলা বিধান যদি যথাযথই হবে, তাহলে সেখানে অনৈতিকতা ও নানামাত্রিক দুর্নীতির প্রবেশ ঘটে কিভাবে। রোহিঙ্গা যুবারা অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ে জড়িত হয় কিভাবে।

মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র ব্যবসা বাংলাদেশি সমাজের জন্য বাড়তি সমস্যা ডেকে আনবে, জঙ্গি তৎপরতা বাড়ার অতি সম্ভাবনা তৈরি করবে। এসব বিপদের কথা প্রশাসনের মাথায় কতটা বিচক্ষণতায় কাজ করছে তা আমরা জানি না। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবনে প্রশাসন এসব দিকে সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ দুর্যোগের সমূহ সম্ভাবনা।

সে দুর্যোগের পেছনে রয়েছে স্থানীয় নানাবিধ স্বার্থপরতা, স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশ চেতনার অভাব, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশল ও শক্তিমান রাষ্ট্রের স্বার্থপরতা। এর মধ্যে সংযোগ রক্ষায় অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও তৎপরতা। চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণের  সাক্ষ্যপ্রমাণ কিসের আলামত, বাংলাদেশ সরকারকে অতি গুরুত্বে তা ভেবে দেখতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক খেলার কিছু আভাস-ইঙ্গিত এর মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। থলে থেকে কখন বিড়াল বেরিয়ে আসবে সেদিকে কি সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের তথা সরকারের। বেশিদিন আগে নয়, এই ২৭ জুন (২০১৯) একটি দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধের তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনাম : ‘রোহিঙ্গাদের জন্য মানচিত্র বদলের প্রস্তাব।’ এর প্রেক্ষাপটে রয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতা, যেমন বাংলাদেশের তেমনি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘ দুর্বোধ্য কারণে  এ বিষয়ে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারছে না।

কেন? ভয় কোথায়, কাকে! চীন, রাশিয়া, ভারতের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বিশ্বসুদ্ধ মানুষ জানে, জানি আমরাও। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র? তাদের ভূমিকা বড় অস্পষ্ট। পূর্বোক্ত নিবন্ধে প্রকাশিত একটি খবর তাতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের  প্রতিনিধি পরিষদের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি অভিনব প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন দক্ষিণ সুদানের বিভাজক উদাহরণ টেনে।

তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি স্থান হিসেবে বিবেচনার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর যুক্তি, সুদান নিয়ে সমস্যা মেটাতে যদি বিভাজনের চিন্তা করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য এ রকম মানবিক চিন্তা সম্ভব নয় কেন? এতে এক ঢিলে দুই পাখি নয়, একাধিক পাখি মারা সম্ভব হতে পারে।

মিয়ানমারকে যেমন তাদের রক্তাক্ত ঔদ্ধত্যের জন্য শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, তেমনি এই সূত্রে চীনকে একহাত নেওয়া যাবে। আর এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে  নতুন জাতিগত সমস্যায় ফেলে হাতের মুঠোয় রাখা সম্ভব হতে পারে। আসলে উদাহরণ যদি সুদানই হয়ে থাকে, তাহলে স্বাধীন রাখাইন রাষ্ট্র নয় কেন, যেখানে স্থানীয় বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, রোহিঙ্গা সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হতে পারে? এ কাজ জাতিসংঘের  তত্ত্বাবধানে সম্ভব। তবে প্রশ্ন: চীন কি তা মেনে নেবে? নিরাপত্তা পরিষদে এমন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার সুযোগ তার রয়েছে, সঙ্গে থাকবে রাশিয়া।

তিন.

এমন এক জটিল পরিস্থিতি সামনে রেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যান। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের  ফেরত পাঠানো ছিল বড় একটি আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যে নমনীয় নীতিতে চলেছে তাতে কোনো কাজ হয়নি। এখন দরকার কঠিন যুক্তিনিষ্ঠ নীতি, আন্তর্জাতািক মিত্র দেশগুলোকে বাস্তব সত্য বুঝিয়ে দেওয়া যে কোনো দেশেই শরণার্থী স্থায়ী বসবাস করে না। তাদের একসময় স্বদেশে ফিরে যেতেই হয়। এটাই আন্তর্জাতিক বাস্তবতা।

চীন নানাভাবে বাণিজ্যে-বিনিয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে  ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বঙ্গোপসাগর নিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক স্বার্থও এ ক্ষেত্রে জড়িত। চীনকে এখন এগিয়ে আসতে হবে।

আর ভারত? বাংলাদেশের বহু সুবিধাভোগী মিত্র দেশ। ভারত কেন এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করবে না? বাংলাদেশই বা কেন এ ব্যাপারে মোদি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না। সর্বোপরি চীনকে বোঝানো দরকার যে রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশকেও চীনের দরকার মিয়ানমারকে সঙ্গে রেখেও চীন-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে। এ রাজনৈতিক হিসাবের সুবিধা বাংলাদেশকে নিতে হবে, কাজে লাগাতে হবে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে। চীন সফরে এটা হতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী

  যশোরের আলো
  যশোরের আলো