রোববার   ১০ ডিসেম্বর ২০২৩   অগ্রাহায়ণ ২৫ ১৪৩০   ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

যশোরের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

নিউজ ডেস্ক

যশোরের আলো

প্রকাশিত : ০১:১৬ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩ বৃহস্পতিবার

ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে বছরের প্রায় ছয় মাস ফুলের সৌরভে মন ভরে না চাষিদের। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাজারে ফুলের চাহিদা কম থাকে। এমন কী এ সময় উৎপাদিত ফুল গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।

বর্তমানে অবিক্রিত ও ক্ষেতের ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে প্রসাধনসামগ্রীসহ নানা ধরনের বাহারী পণ্য তৈরি করছেন নারীরা। ফুলের রাজধানী গদখালীর অদূরে ফুল কানন পানিসারা এলাকার ৩০ নারী ফুলচাষের পাশাপাশি নানা প্রসাধনসামগ্রী তৈরি শুরু করেছেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করছেন এসব নারীরা। 

ফুল কানন পানিসারা গ্রামে বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্রের একটি কক্ষে ১০-১২ জন নারী গোলাপের শুকনা পাপড়ি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ওয়ালমেট, হাতের চুড়ি, কানের দুল, চাবির রিং, ফটোফ্রেম ও কলম তৈরি করছেন। আবার গোলাপের শুকনো সেই পাপড়ি ব্লেন্ডারের মাধ্যমে গুঁড়ো করে আগরবাতি ও সাবান বানাচ্ছেন। এছাড়া সতেজ গোলাপের পাপড়ি ও গাঁদা ফুল জ্বালিয়ে রঙ বানিয়ে কাপড়ে বুটিকের ছাপে বিভিন্ন রূপায়নের কাজও করছেন তারা। 

রজনীগন্ধা ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি করা হচ্ছে সুগন্ধি তৈল। অবিক্রিত ও ক্ষেতের ঝরে পড়া এসব ফুলের পাপড়ি দিয়ে নতুন এ উদ্যোগের শুরুর আগে পানিসারা গ্রামের নাসরিন নাহার আশা, রাবেয়া খাতুন ও হাড়িয়া গ্রামের ফুলচাষি সাজেদা বেগম হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তারা চলতি বছর ৭-১৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পের মাধ্যমে সোসাইটি ফর ব্রাইট সোশ্যাল সার্ভিসেসের বাস্তবায়নে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ড. ওয়াইএসআর হর্টিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বাই-প্রোডাক্ট তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।

কথা হয় রাবেয়া খাতুনের সাথে। তিনি বলেন, ভারতের ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পর প্রতিবেশীর বাড়িতে ছাগলকে গোলাপ ফুল খাওয়াতে দেখি। তখন সেখান থেকে কয়েকটি গোলাপ চেয়ে নিজের বাড়িতে আনি। সেই গোলাপের পাপড়ি ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন ওয়ালমেট তৈরি করি। সেটি এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে আমার এসব কাজের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। এখন নিয়মিত তা হতে চুড়ি, কানের দুল, চাবির রিং, ফটোফ্রেম ও কলম তৈরি করি। শুকনো পাপড়ি ব্লেন্ডারের মাধ্যমে গুঁড়ো করে আগরবাতি ও সাবান বানাই। এ ছাড়া তাজা গোলাপের পাপড়ি ও গাঁদা ফুল নির্দিষ্ট তাপে জ্বালিয়ে রঙ বানিয়ে কাপড়ে বুটিকের ছাপের কাজও করি। বাড়িতে বসে গোলাপ-গাঁদা-জারবেরা ফুল প্রক্রিয়াজাত করে সাবানের পাশাপাশি গোলাপজলও তৈরি করি। মাথার চুলে ব্যবহারের জন্য নারকেল তেলের সঙ্গে জবা ফুল মিশিয়ে সুগন্ধি তেল বানাই। এসব কর্মকাণ্ড দেখে গ্রামের অনেক নারী উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও প্রসাধনসামগ্রী তৈরি করছেন। 

রাবেয়া খাতুন আরো বলেন, আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা অন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দলগতভাবে কিছু করার চেষ্টা করছি। সবাই উদ্যোক্তা হতে চাই। আমাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘ফুল ও ফুলের কাজ’ শিরোনামে একটি পেজও খুলেছি। কিন্তু কারখানা করার মতো পূঁজি আমাদের নেই। এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এটা হলে গ্রামের অনেক নারীর বাড়িতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। 

এলাকায় ফুল চাষে সম্পৃক্ত ৩০ নারীকে নিয়ে পানিসারা গ্রামে ফুল থেকে বিকল্প পণ্য (বাই-প্রোডাক্ট) তৈরির নারী দল গঠন করা হয়েছে। এসব নারীরা বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্রের একটি কক্ষে বসেন। সেখানে প্রতিদিন বিকেল ওই নারীদের ফুলের বাই-প্রোডাক্ট তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নাসরিন নাহার আশা ও রাবেয়া খাতুন নিয়মিত এসব নারীদের প্রশিক্ষণ দেন। হাতে-কলমে শেখান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাজেদা বেগমও যোগ দেন মাঝেমধ্যে।

নাসরিন নাহার আশা বলেন, ফুল চাষে জড়িত বিভিন্ন গ্রামের ৩০ জন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করেছি। এসব নারীদেরকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সকলেই কম-বেশি ফুলের বাই-প্রোডাক্ট তৈরি করছেন। আমরা একটি কারখানা স্থাপন করতে চাই। 

আশা আরো বলেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও প্যাকিং করতে হলে অন্তত দুটি যন্ত্র বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ওই যন্ত্র কেনা ও কারখানা স্থাপনে ৫০ লাখ টাকা দরকার। এতে সরকার ভর্তুকি দিলে এটি সম্ভাবনার খাত হতে পারে। কারণ, কাঁচামাল আমাদের হাতের নাগালে।

ফুল কানন পানিসারায় অবস্থিত বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্রটি ওই নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা করে যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেড। 

প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ফুলচাষিরা বছরের ছয় মাস লোকসানে থাকেন। বাজারের অবিক্রিত ফুল নষ্ট হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফুল থেকে অর্গানিক প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়। ফুল দিয়ে বিকল্প পণ্য তৈরি হলে অর্থনীতিতে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এ জন্য তিন নারীকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। তারা ফিরে গ্রামের ৩০ জনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এখন তাদের একটি কারখানা দরকার। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।