শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

  যশোরের আলো
৩২২

কোভিড-১৯ এর বিপর্যয় মোকাবিলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রভাব

নিউজ ডেস্ক:

প্রকাশিত: ১ জানুয়ারি ২০২১  

আমরা শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক বছরের শেষে পৌঁছেছি, কারণ ২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী জনগণ ব্যাপক দুর্ভোগের স্বীকার হয়েছে।

এই মহামারীর ফলে বিশ্বব্যাপী ঘটেছে অর্থনৈতিক মন্দা, এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, জনসাধারণের চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, বিভিন্ন অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এবং নাগরিকদের এই মারাত্মক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে নিরাপদ স্যানিটেশন অনুশীলন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সুতরাং, এই বছরটি শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহামারী হিসাবে একাধিক প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল দেশকে প্রভাবিত করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে, মহামারী সৃষ্ট বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন পরিপক্ব রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এই মহামারীর সর্বনাশা প্রভাব বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরকে প্রভাবিত করেছে। কোভিড-১৯, যা অর্থনীতি ও শ্রমবাজারকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, এর সংক্রমণ রোধ করার প্রয়াসে সরকার মার্চ মাসে ছুটি ঘোষণা করে। অন্যান্য দেশের মতো মহামারীর কারণে বাংলাদেশি অর্থনীতিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে, প্রায় এক লক্ষ একুশ হাজার কোটি টাকা মূল্যের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে। সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বেকারদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে অনেকাংশে বেড়েছে, কারণ অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কোভিড-১৯ এর নেতিবাচক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে।

মহামারী চলাকালীন সময়ে খেটে খাওয়া মানুষের উপার্জন যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং, বেকারত্ব এবং উপার্জন হ্রাসের মাধ্যমে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার এই অভাবী জনগোষ্ঠীর মানুষদের সহায়তা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের সহায়তা করার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- উন্মুক্ত বাজারে স্বল্প মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রয়, দরিদ্র জনগণের কাছে সরাসরি নগদ সাহায্য স্থানান্তর এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওয়তায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এই পদক্ষেপগুলো দরিদ্র মানুষদের এই কঠিন সময়ে জীবিকা নির্বাহ করতে সহায়তা করেছে।

অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি মারাত্মক এই ভাইরাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য খাতের উপর। এ বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোভিড-১৯ -এর স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল না। ফলে এই মহামারীকালীন সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থার চিত্র দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যা জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এমনকি, মহামারীর প্রথম ধাপে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কোভিড -১৯ এর চিকিৎসা সংক্রান্ত অনীহা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। সময়ের সাথে সাথে সরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কোভিড শনাক্তের পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি, অধিক পরিমাণ অক্সিজেনের ব্যবস্থা, হাসপাতালে আইসিইউ বেডসহ শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি এবং রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।

সরকার এ ক্ষেত্রে কাঙ্খিত পর্যায়ের সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও এ কথা সকলকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে দেশে জুন মাসের পর থেকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির বেশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এমনকি, সরকার স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জন্য এই বছরের বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। স্বাস্থ্য খাতে কিছু ব্যাক্তির দুর্নীতি সরকারের সুনাম নষ্ট করলেও তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবিদার।

সরকারের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা। এর মূল কারণ হলো- দেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের এই মরণ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশিকাগুলো মেনে চলার প্রতি অনীহা রয়েছে। জনগণকে ঘরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার সময়ে সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মাস্কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার এবং "নো মাস্ক, নো সার্ভিস" সিধান্ত বাস্তবায়ন। তবে, এই সিদ্ধান্তের কার্যকরতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সরকার এই নির্দেশিকাগুলো বাস্তবায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের সচেতনতা বৃদ্ধিমুলক-প্রচার অভিযান বাস্তবায়ন করেছে। এটি ঠিক যে চলাফেরার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষত শিশুদের উপর নেতিবচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তবে, এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ডব্লিউএইচও প্রস্তাবিত কৌশলগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে নাগরিকদের অবশ্যই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। মহামারী সৃষ্ট "নিউ নর্মাল" জীবন পদ্ধতি মোকাবিলায় সক্ষম করার জন্য সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, এবং মাস্ক পরিধানসহ বিভিন্ন ধরণের সচেতনতামূলক বার্তা সরবরাহ করে আসছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে প্রায় আট লক্ষ অভিবাসীকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। তবে সরকার হতাশ হননি। বরং বিকল্প কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার এই প্রত্যাবাসিত অভিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একটি ইতিবাচক বিষয় হলো করোনাকালে অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তন সত্ত্বেও, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। এটি অর্থনীতির গতি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। সরকার উৎপাদনশীল খাতে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের জন্য সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে যা অনেক বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এই পদক্ষেপ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে পোশাক শিল্প খাত, যা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ হারিয়ে, পোশাক শিল্পের মালিকরা কর্মীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে যার ফলে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। তবে, সরকার এই খাতকে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসা চালিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে। অতএব, খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই শিল্প পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশ ও এজেন্সি যেন বাংলাদেশ থেকে তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল না করে সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী ব্যবসা কূটনীতি (বিজনেস ডিপলোম্যাসি) পরিচালনা করেছেন যার জন্য তিনি প্রশংসার যোগ্য। এই আলোচনা পোশাক শিল্পকে তার মর্যাদা ফিরে পেতে সহায়তা করেছে।

করোনাকালে অনলাইনে বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের একটি। প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম স্বপ্ন ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার ২০০৮ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার নির্দেশনায় কাজ করে চলেছে। এই মহামারী চলাকালীন সময়ে, মানুষ ঘরে বসে অনলাইনে অনেক ধরনের সেবা পাচ্ছে বিধায় সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিতে শুরু হয়েছে। এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ এবং বিদ্যুতায়নের প্রসার শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। বিভিন্ন অনলাইন পরিষেবার পাশাপাশি, অনলাইন ব্যবসায়ের বাজারটি ব্যাপক ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে যা সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।

যদিও বছরটি শেষ হতে চলেছে, আমরা কখন এই মারাত্মক ভাইরাসের প্রভাব দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব তা নিশ্চিত নয়। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষ টানেলের শেষ কিনারে আলোর ঝিলিক দেখতে শুরু করেছে, যদিও এই ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ কার্যকারিতা নিয়ে এখনও সন্দেহ রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন ক্রয় ও বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে এর বিতরণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। তাছাড়া, সকল নাগরিককে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের সরকারি সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবিদার।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ এই মহামারীর ধ্বংসাত্মক প্রভাব মোকাবিলায় লড়াই করে চললেও, বাংলাদেশ মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। এর সর্বময় কৃতিত্বের অধিকারী আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যার পরিপক্ব এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল সময় অতিবাহিত করতে আমাদের সহায়তা করেছে। আমরা আশা করি যে এই মহামারী এক দিন শেষ হয়ে যাবে। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের পুনর্গঠনের জন্য আমাদের সকলকে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আসুন আমরা ২০২১ সালে কোভিড-১৯ মুক্ত একটি বিশ্ব প্রত্যাশা করি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করি।

লেখকঃ ড. প্রণব কুমার পান্ডে, প্রফেসর, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  যশোরের আলো
  যশোরের আলো