শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

  যশোরের আলো
৪৭৪

গবেষণার জন্য একটা ভালো মন থাকলেই চলে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ

প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮  

মনের সাথে গবেষণার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে| চিন্তাশীলতা , দায়বদ্ধতা ও আনন্দপূর্ণ মন মানুষের মধ্যে গবেষণার ধারণা সৃষ্টি করে| এই গবেষণার তীর্থস্থান হল বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু তার প্রতিফলন কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? নাকি গবেষণা ফোবিয়াতে ভুগছেন সামনের কাতারে যাদের থাকার কথা সেই শিক্ষকরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান হচ্ছে গৌণ, কিন্তু জ্ঞানের উদ্ভাবন ও গবেষণা হচ্ছে মুখ্য। এখানে মুখ্য বা গৌণ বিষয়ের দিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দৃষ্টি নেই, তেমনি গবেষণার কথা বললেই অনেকেই বলছেন এদেশে গবেষণার পরিবেশ নেই। সব শিক্ষককে হয়তো একইভাবে বিবেচনা করা যাবে না। কারণ অনেকেই বলছেন, গবেষণার জন্য পরিবেশ নয়, দরকার মানসিকতার। তবে সংখ্যার বিচারে কোন পক্ষ বেশি হবে তা বলা খুব কঠিন নয়। যদি আমরা বলি গবেষণার মাধ্যমেই উন্নত রাষ্ট্র গঠন সম্ভব তবে আমাদের দেশে গবেষকদের গবেষণার ফলাফল এক্ষেত্রে কতটা প্রভাব রাখছে তা হয়তো আমরা সবাই কমবেশি জানি। দেশ-বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে অনেকেই ভাবছেন গবেষণা করে কোনো লাভ নেই বরং তাতে সময়ের অপচয়। তাহলে রবীন্দ্রনাথ কবি হয়েও কেন বললেন উদ্ভাবন ও গবেষণা দরকার। অনেকে বলবেন উনি কবি, আবেগ থেকে অনেক কথাই বলতে পারেন। কথাটা কিন্তু সত্য নয়। এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানের আদান প্রদান করতেন।

 

আবার যখন রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন তখন তিনি তাদের বিজ্ঞানের সহজ ও জটিল বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাহলে এখানেও কোনো ধরনের যুক্তি চলছে না। যদি বলা হয় পিএইচডি কী? তবে বলা যেতে পারে পিএইচডি হল কোনো একটি ছোট বিষয় নিয়ে কাজ করা ও গবেষণা করতে শেখা। পিএইচডিও করা হল, গবেষণাতেও হাতেখড়ি হল; কিন্তু তারপর গবেষণার ‘গ’ পর্যন্ত নেই। যদি গবেষণা না থাকে তবে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি কীভাবে হবে আর নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাদানের কথা তারও বা কী হবে। কারণ বড় বড় লেখকদের বইয়ের রেফারেন্স আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেই। মনে করি আমাদের পুরো দায়িত্বই শেষ হয়ে গেছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। বড় বড় লেখকদের বই পড়ে পড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ হতে পারে না। কেননা স্কুল ও কলেজে বড় বড় লেখকদের বই পড়ানো হয়। সেটাই যদি হয়ে থাকে তবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্কুল ও কলেজের কাতারে নিয়ে আসছি কিনা বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

এখানে বই পড়াকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না। আদিকালে পাথরের বই ছিল। এরপর কালো ছাপা অক্ষরে কাগজের বই এলো। আর এখন আমরা সবাই ই-বুকের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। কোনোটাকেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি বড় বড় লেখকদের বই পড়ে সেটাই শিক্ষার্থীদের ধারণা দেন তবে এটাকে নকল করা বলা যাবে কিনা তা বিবেচনার বিষয়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেটি করতে পারেন, তা হল বিভিন্ন লেখকদের বই তো তারা পড়বেনই, এর সঙ্গে তারা যে বিষয়টি পড়াবেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে তার ধারণা গ্রহণ করবেন বিভিন্ন ধরনের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগুলো পাঠ করে। আবার যে বিষয়টি তিনি পড়াবেন তার মৌলিক ও ফলিত গবেষণাও তাকে করতে হবে। এর কারণ হল যদি গবেষণা নিজে করা না যায় তবে একজন শিক্ষকের জ্ঞানকে পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান সৃষ্টির ধারণার সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর এ কারণেই একজন শিক্ষককে গবেষণার সঙ্গে আজীবন সম্পৃক্ত থাকতে হয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে গবেষণা যদি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কাজ না করে তবে সেই শিক্ষকতার কোনো মূল্য আছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।

আজকাল আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তা হল শিক্ষকরা পিএইচডি করছেন শুধু পদোন্নতির জন্য। পিএইচডি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আর্টিকেল জার্নালে পাবলিশ করে যখন একজন শিক্ষক অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন, তখন তার গবেষণা নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। আর জার্নালে যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে তার গুণগত মান ও জার্নালের মানের বিষয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। তারপরও সবার একই কথা এদেশে গবেষণার পরিবেশ নেই। এটা হতাশা নাকি অনাগ্রহ তা তা বলা কঠিন। হতাশা এ কারণে বলা হচ্ছে বিদেশের নামিদামি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে যখন গবেষকদের চোখ বড় বড় হয়ে যায় তখন তারা দেশে এসে নাকি সবকিছুই অন্ধকার দেখেন। অন্ধকার বলে তারা গবেষণাকে এড়ানোর একটা সহজ সরল যুক্তি তৈরি করেন। যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আরেকটি কারণ এখানে কাজ করে তা হল অধ্যাপক হওয়ার পর একজন শিক্ষক নিজেকে গবেষণায় যুক্ত রেখেছেন কিনা তার কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। সব যেন মগের মুল্লুক। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশে অধ্যাপক হওয়ার পর গবেষণার দায়বদ্ধতা আরও বেশি বেড়ে যায়। এমনকি গবেষণা করতে না পারলে চাকরি হারাতে হয় অথবা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এটি কোনো মনগড়া কথা নয়। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধারাই প্রচলিত আছে। তবে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে গোটা বিশ্বে গবেষণা মানে ব্যবসা। এর অর্থ হল গবেষণা করে গবেষকরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। আর গবেষণাপত্র প্রকাশ করলে অর্থ পায়। প্যাটেন্ট করলে অর্থ পায়। আবার স্বীকৃতিও পায়। তখন প্রশ্ন আসে তারা তো সবই পায় কিন্তু আমরা তো কিছুই পাই না। অথচ পৃথিবীটাই চলছে দেনা-পাওনার ওপর। তাহলে গবেষণা করে লাভ কি। কারণ সময়ের তো মূল্য আছে।

কিন্তু বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে বিবেচনা করাটাই ভুল। এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর কোনো দেশই প্রাথমিক অবস্থায় তাদের গবেষকদের কাজের বিনিময়ে অর্থের ব্যবস্থা করতে পারেনি। যদি ধরে নেয়া যায় আমরাও সে অবস্থায় আছি তবে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কি বন্ধ করে দিতে হবে, নাকি আমার নেই বলে আমাকে অর্থের পিছনে না ঘুরে নিজের দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার কাজ আমৃত্যু চালিয়ে যেতে হবে? এখানে সবচেয়ে বড় কথা হল, আমাদের দেশপ্রেমের বড়ই অভাব। আর দেশপ্রেমের অভাব বলেই আমরা বিজ্ঞানমনস্ক না হয়ে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু বিবেচনার চেষ্টা করছি ও এর পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি তুলে ধরছি। যুক্তি তুলে ধরতে আমাদের কোনো জুড়ি নেই। অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। আর আমরা এতই আবেগপ্রবণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা ও শিক্ষাদান করুক বা না করুক তাদের চাকরি সারাজীবনের জন্য সুরক্ষিত আছে। যেখানে একজন মানুষ আগেই জানে যে তার চাকরি আজীবন নিরাপদ তার আর গবেষণার প্রতি জোর করেও আগ্রহ ও মানসিকতা তৈরি করা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে জুনিয়র শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা গবেষণা শেখার জন্য কার শরণাপন্ন হবে তা বুঝে উঠতে পারে না। ফলে তাদের আর গবেষণা করা হয় না। এ থেকে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা জন্ম নেয় যার ফলাফল হয় দীর্ঘমেয়াদি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় তারাও একসময় গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়ে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্র্থীদের উৎকর্ষের কথা বিবেচনা করে অনেক শিক্ষককে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠালেও তাদের বেশিরভাগই আর ফিরে আসেন না। এতে তাদের দেশপ্রেম ও কৃতজ্ঞতাবোধের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু বিদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও আমাদের দেশের আজকের সমৃদ্ধি লক্ষ্য করে আজকাল দেশে ফেরার প্রবণতাও বাড়ছে। এটি শুভ লক্ষণ। তবে দেশে ফিরে তাদের আর গবেষণার মনোভাব থাকছে না।

শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিতই করে না বরং গৌরবান্বিত করে। এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হল শিক্ষা ও গৌরব। একজন শিক্ষক তার মৌলিক ও ফলিত গবেষণার মাধ্যমেই গৌরবান্বিত হতে পারে। আবার যে শিক্ষক গবেষণা ও উদ্ভাবনে নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত রেখেছেন, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালের গবেষণাগুলোতেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই শিক্ষা ও গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়ছে।

ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখব, সক্রেটিস ছিলেন প্লেটোর শিক্ষক, প্লেটো ছিলেন অ্যারিস্টটলের শিক্ষক, অ্যারিস্টটল ছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক। এখানে শিক্ষা, দর্শন ও গবেষণা একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ট্রান্সফার হয়েছে। তবে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক থাকলেও তাদের জ্ঞান সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও ভিন্নতা ছিল। আর তাদের সবাইকে আজকের দিনে আমরা রথী-মহারথী হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু আজকে কেন গুরু-শিষ্যের এই ধারার বিলুপ্তি ঘটেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে অন্যান্য লোভনীয় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এদিকে লক্ষ্য রেখে বর্তমান সরকার গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রকল্প দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও গবেষণা ক্ষেত্রে প্রকল্প প্রস্তাবের জন্য আহ্বান করছে। দেশ-বিদেশ থেকেও আজকাল গবেষষণা প্রকল্প পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও তেমনভাবে শিক্ষকদের মধ্যে সাড়া পড়ছে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

সবশেষে বলা যায়, গবেষণার পরিবেশ আছে, গবেষণার অবকাঠামোও আছে; কিন্তু নেই গবেষণার মানসিকতা। ইচ্ছা থাকলে মানুষ যেকোনো ক্ষেত্রে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে নেয়। অনেক শিক্ষকের নীরবে-নিভৃতে মৌলিক ও ফলিত গবেষণা চালিয়ে যাওয়া তারই উদাহরণ। তারা প্রচারের আলোয়ও থাকেন না। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন দেশ আমাকে কী দিল সেটি বড় কথা নয়, দেশকে আমি কী দিলাম সেটিই বড় কথা। শিক্ষকদের মূল কাজই যে শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা, এ দায়বদ্ধতা ও মানসিকতা নিজের মধ্যে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে না, দেশও তেমনি জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে পারবে না। তাই সময়ের প্রয়োজনেই শিক্ষকদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলাতে হবে। গবেষণামুখী হতে হবে।আর একটা উদার নিঃস্বার্থ মনও গবেষকদের থাকতে হবে| গবেষণামনস্ক মানুষ কেবল বিজ্ঞানের ধারণাকে এগিয়ে নেয়না বরং মানুষকে এগিয়ে নেয় |

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

  যশোরের আলো
  যশোরের আলো